দীর্ঘ কয়েক বছর প্রয়োজনের সময় কাঙ্ক্ষিত সেচ সুবিধা না পাওয়া গেলেও এবার মৌসুমের শুরুতেই পানি মিলছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পে। এতে শুধুমাত্র কুষ্টিয়া জেলাতেই ১১ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে সেচ সুবিধা পাবেন পাশ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষকরাও। বোরো আবাদে কৃষকের বিঘা প্রতি খরচ অন্তত ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে।
কৃষক ও সংল্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে কথা বলে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার অন্তত ১১ হাজার হেক্টর জমিতে এবার জিকের পানিতে বোরো আবাদ হবে। মাসখানেক খালে পানি পেলেই তাদের খরচ বাঁচবে বিঘাপ্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। আর যদি পানি পুরো মৌসুমজুড়েই থাকে, তাহলে ব্যয়ের মাত্রা অনেকটাই নেমে আসবে কৃষকের। এছাড়াও পেঁয়াজসহ বেশকিছু মাঠে থাকা ফসলও উপকৃত হবে এই জিকের পানিতে।
পদ্মায় পানি সংকট ও জিকের সেচ পাম্প নষ্ট থাকায় গত দুই থেকে তিন মৌসুম ধরেই ঠিকমতো পানি মিলছে না কৃষকদের। গত বছর মৌসুমের শেষভাগে পানি আসলেও তাতে কৃষকের কোনো লাভ হয়নি। তবে আগেভাগে পানি পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের কৃষক আক্কাস আলী জানান, আমরা ধরেই নিয়েছি জিকের পানি পাব না। সেই হিসেব করেই চারা রোপন করা। এখন জিকের পানি তাদের জন্য বাড়তি বোনাস হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
এ সময় অন্যান্য কৃষকরা জানান, যেসব জমিতে খালের পানি যাবে না, তারাও পরোক্ষভাবে লাভবান হবেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গত দুই তিন মৌসুমে তাদের এলাকার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ঠিকমতো পানি ওঠে না শ্যালো ইঞ্জিনে। ক্যানেলে পানি থাকলে এবার আর এই সমস্যায় পড়তে হবে না।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কুষ্টিয়ার উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, এই পানিতে ধান চাষে কৃষক ভালো মুনাফা পাবেন। বোরো মৌসুমে সেচ বাবদই বেশি ব্যয় করতে হয় কৃষককে। তাছাড়া অন্যান্য ফসলও সুবিধা পাবে। তবে আউশ ধান যারা লাগাবে তারা বেশি সুবিধা পাবেন। চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে কৃষকরা আউশ ধানের বীজতলা শুরু করবেন। আর রোপন শুরু হবে আরো ২০ থেকে ২৫ দিন পর।
তিনি আরও জানান, জেলায় এবছর বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৪৬৪ হেক্টর জমিতে। তবে আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে।
জিকে সেচ ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সভাপতি সাফায়েত হোসেন পল্টু বলেন, গত বছর খালে পানি সরবরাহ না করায় অনেক সমস্যা হয়। অনেক জমি অনাবাদি ছিল। সেচ সরবরাহ সচল হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। পরিবেশও রক্ষা হবে।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান জানান, গত ৬ মার্চ থেকে সচল একটি পাম্প দিয়ে জিকে খালে পানি সরবরাহ শুরু হয়েছে। অপর একটি পাম্পও সচল করার জন্য কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে চলতি মাসেই পাম্পটি সচল করে জিকে খালে পানি সরবরাহ করা যাবে। তবে আরেকটি পাম্প একেবাইে অকেজো। সেটি কোনোভাবেই মেরামত যোগ্য নয়।
আরও পড়ুন: দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে নরসিংদীর বিসিক শিল্পনগরী
২০০৯ সালে জাপানের একটি কোম্পানি থেকে ৩টি বড় পাম্প এনে স্থাপন করা হয়। তবে গত বছর তার দুটি বিকল হয়ে পড়ে। অন্যটি পানির অভাবে গত বোরো আবাদের সময় বন্ধ রাখতে হয়। জাপানের প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তারা পরিদর্শন করেছেন। কিছু যন্ত্রাংশ ইতোমধ্যে আনা হয়েছে। বাকি যন্ত্রাংশ বন্দরে এসেছে।
তিনি জানান, পদ্মার ভেড়ামারা পয়েন্টে পানির লেভেল ৪ দশমিক ৪০ মিটার রয়েছে। ৪ দশমিক ২০ মিটার পর্যন্তও পানি সরবরাহ করা যাবে। এর নিচে নামলে পানি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। ৩টি পাম্প একসঙ্গে চালু থাকলে প্রতি সেকেন্ডে ৩ হাজার ৯০০ কিউসেক পানি আবাদি জমিতে দেওয়া সম্ভব হয়। একটি পাম্প দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৩শ’ কিউসেক পানি পাওয়া যায়।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের আওতাধীন জেলা চারটি হলেও বোরো মৌসুমে মূলত কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রশিদুর রহমান বলেন, ৪টি জেলায় জিকের খাল বিস্তৃত। জিকের পাম্প হাউস আধুনিকায়নসহ খাল সংস্কারের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার টাকা কাটছাঁট করে সেটি ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় করার পরামর্শ দিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দুটি বড় ও ৫টি ছোট পাম্প স্থাপন করা হবে। খাল সংস্কারসহ গাছ লাগানো হবে। নতুন পাম্প স্থাপন করা হলে পদ্মার পানি ৩ সেন্টিমিটারের নিচে নামলেও পানি সরবরাহ সচল থাকবে।
সূত্র জানায়, ১৯৫৯ সালে প্রধান পাম্প হাউজের কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬২ থেকে ৬৩ সালে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। তখন চাষযোগ্য ফসলি জমি ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ হেক্টর। পরবর্তীতে পাম্পের ক্যাপাসিটি কমার সঙ্গে সঙ্গে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৬১৬ হেক্টর। শুরুতে তিনটি পাম্প দিয়ে বছরে ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আক্টোবর পর্যন্ত) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা যেত। বাকি ২ মাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাম্প তিনটি বন্ধ রাখা হত। ৩টি পাম্প সচল থাকলে ৪ জেলার ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
আরও পড়ুন: ফরিদপুরে পেঁয়াজ বীজের বাম্পার ফলন, ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা